বোয়ানথ্রপি: মানুষের বিরল মানসিক ব্যাধি, যা বাস্তবতা-বোধকেই উল্টে দেয়

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বিজ্ঞানের অগ্রগতির পরও মানবমস্তিষ্কের অনেক রহস্য এখনো অনাবিষ্কৃত। এর মধ্যে অন্যতম হলো বোয়ানথ্রপি (Boanthropy) নামের এক বিরল মনোবৈকল্য, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে তিনি একটি গরু বা ষাঁড়-এবং সেই বিশ্বাস অনুযায়ী চলাফেরা, খাওয়া, এমনকি সামাজিক আচরণও পরিবর্তিত হয়।
বোয়ানথ্রপি কি??
বোয়ানথ্রপি মূলত ডিলিউশনাল মিসআইডেন্টিফিকেশন সিন্ড্রোম (Delusional Misidentification Syndrome)-এর একটি বিশেষ রূপ, যেখানে মস্তিষ্কের রিয়েলিটি-অরিয়েন্টেশন প্রসেস বিকৃত হয়ে যায়। রোগীর 'সেল্ফ আইডেন্টিটি' বা নিজেকে চেনার ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে তিনি অন্য প্রজাতি হিসেবে নিজেকে ভাবতে শুরু করেন।
বাইবেলের 'বুক অফ ড্যানিয়েল'-এ ব্যাবিলনের রাজা নেবুচাদনেজারের ঘটনা সবচেয়ে বিখ্যাত। বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি কিছু সময়ের জন্য গরুর মতো মাঠে ঘাস খেতেন এবং মানুষের জীবনযাপন ছেড়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া, কিছু ইউরোপীয় রেকর্ডে উল্লেখ আছে, মধ্যযুগে কয়েকজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, যারা গরুর মতো আচরণ করতেন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতেও কয়েকটি ক্লিনিকাল কেস ডকুমেন্ট করা হয়েছে, যেখানে রোগীরা দীর্ঘ সময় নিজেদের গরু হিসেবে চিনতেন।
সম্ভাব্য কারণ: বোয়ানথ্রপির পেছনে একাধিক জটিল কারণ থাকতে পারে-
1. মনোরোগ: সিজোফ্রেনিয়া, সাইকোটিক ডিসঅর্ডার বা তীব্র ডিপ্রেশন।
2. স্নায়ুবিক ব্যাধি:মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব, টেম্পোরাল লোব বা লিম্বিক সিস্টেমে আঘাত বা টিউমার।
3. ট্রমা ও মানসিক চাপ: গভীর মানসিক আঘাত অনেক সময় অবচেতন মনকে এমন বিভ্রম তৈরি করতে বাধ্য করে।
4. সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাস: কিছু ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক প্রথা বা সাংস্কৃতিক ধারণা এই বিভ্রমের পটভূমি তৈরি করতে পারে।
উপসর্গ ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য:
১। চার হাত-পায়ে হাঁটা বা মাটিতে বসে থাকা
২। মানুষের খাবার প্রত্যাখ্যান করে ঘাস বা গাছপালা খাওয়ার চেষ্টা
৩। সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া
৪। গরুর মতো আওয়াজ তোলা
৫। বাস্তবতা-বোধ হারানো এবং অন্য সবকিছুকে অস্বীকার করা
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বোয়ানথ্রপি আসলে এক ধরনের আইডেন্টিটি রিগ্রেশন—যেখানে ব্যক্তি তার মানসিক চাপ বা অসহায় পরিস্থিতি থেকে পালাতে নিজের পরিচয় বদলে ফেলতে চায়। গরুর মতো সহজ জীবন কল্পনা করা, কাজ, দায়িত্ব ও সামাজিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার অবচেতন প্রচেষ্টা হতে পারে।
চিকিৎসা পদ্ধতি: বোয়ানথ্রপির কোনো সরাসরি নিরাময় নেই, তবে এর মূল কারণ চিকিৎসা করাই লক্ষ্য-
১। সাইকোথেরাপি: কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) বাস্তবতা-বোধ পুনর্গঠনে সাহায্য করে।
২।ওষুধ:অ্যান্টিসাইকোটিক বা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ প্রয়োগ, মূল সমস্যার ধরন অনুযায়ী।
৩। নিউরোলজিকাল পরীক্ষা: MRI/CT স্ক্যান করে মস্তিষ্কের ক্ষতি বা অস্বাভাবিকতা খোঁজা।
৪। পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তা: রোগীর আত্মসম্মান ও পরিচয়বোধ ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণার অভাব ও গুরুত্ব:
বোয়ানথ্রপি এতটাই বিরল যে, বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত কেসের সংখ্যা হাতে গোনা। এর ফলে চিকিৎসা-বিজ্ঞান এই ব্যাধি নিয়ে এখনও গভীর গবেষণার সুযোগ পায়নি। তবুও, প্রতিটি কেস মানবমস্তিষ্কের জটিলতা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে।
বোয়ানথ্রপি শুধু একটি অদ্ভুত রোগ নয়-এটি মানুষের মস্তিষ্ক কতটা জটিল এবং বাস্তবতার ধারণা কত সহজে বদলে যেতে পারে, তার এক বাস্তব প্রমাণ। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা ও সহায়তা রোগীকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে, কিন্তু এজন্য প্রয়োজন রোগটিকে বোঝা এবং অবহেলা না করা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।