বাংলাদেশের ৬৪ জেলার জন্মগাথা: ইতিহাস, বাস্তবতা আর প্রশাসনিক বিবর্তনের শতবর্ষ

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশের মানচিত্রে ছড়িয়ে থাকা ৬৪টি জেলার প্রতিটি যেন একেকটি প্রশাসনিক ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। এই বিভাজন এসেছে সময়ের প্রয়োজনে, মানুষের জন্য, শাসনের সহজীকরণে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কখন, কেন এবং কীভাবে গড়ে উঠল এই জেলাভিত্তিক বর্তমান বাংলাদেশ?
ইতিহাসের প্রারম্ভ:
বাঙালির জেলা প্রশাসনের ভিত্তি গড়ে ওঠে বহু আগে, মুঘল আমল থেকেই কিছু কিছু এলাকা 'সরকার', 'পরগনা' নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু আধুনিক জেলার ধারণা আসে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে। ১৭৮৭ সালে ইংরেজ শাসকরা প্রশাসনিক কার্যক্রম আরও দক্ষ করতে প্রথমবারের মতো বাংলায় জেলা কাঠামো প্রবর্তন করে। সেসময় তৈরি হয় কলকাতা, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলা। তখনকার জেলা নির্ধারিত হতো নদী পথ, কৃষিভিত্তিক জনপদ এবং বানিজ্যকেন্দ্রকে ঘিরে।
ঔপনিবেশিক থেকে পাকিস্তান পর্ব:
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও উপমহাদেশ ভাগের পর পূর্ববাংলা নামে বর্তমান বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জেলা সংখ্যা ছিল মাত্র ১৯টি। এ সময় সীমিত আকারে কিছু নতুন জেলা যুক্ত হলেও প্রশাসনিক কাঠামো এখনও ছিল অনেকাংশে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কাঠামোর উপর নির্ভরশীল।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ: নতুন শাসনের নতুন মানচিত্র
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর শুরু হয় দেশ গঠনের নতুন অধ্যায়। স্বাধীনতার পরপরই দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ, স্বাধীন দেশের চাহিদা ছিল জনগণের কাছে প্রশাসনকে আরও কার্যকরভাবে পৌঁছে দেওয়া।
জেলা বৃদ্ধির যুগ: মহকুমা থেকে পূর্ণাঙ্গ জেলায় উত্তরণ
৭০ ও ৮০-এর দশক ছিল বাংলাদেশের প্রশাসনিক বিস্তারের যুগ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথমবারের মতো মহকুমাগুলোকে জেলা করার চিন্তা নিয়ে এগিয়ে আসেন। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, যখন একযোগে ২০টি নতুন জেলা ঘোষণা করা হয়। এতে দেশের জেলা সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪টি।
এই মহকুমাগুলোর জেলায় উন্নীতকরণ কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তমাত্র ছিল না—এর পেছনে ছিল ভূগোল, জনঘনত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সেবা প্রদানের পরিধি এবং স্থানীয় অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ।
প্রশাসনিক যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
দ্রুত জনগণের সেবা পৌঁছে দেওয়া, স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার তদারকি—এসব চাহিদা থেকেই জেলার সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি নদীমাতৃক, যার ফলে অনেক এলাকায় পৃথক প্রশাসনিক কাঠামো না থাকলে দুর্গম অঞ্চলে সেবা পৌঁছানো কঠিন হয়ে যেত। জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতা এবং অবকাঠামোগত দূরত্বও জেলা বিভাজনের অন্যতম কারণ ছিল।
আজকের চিত্র:
বর্তমানে ৬৪টি জেলা ৮টি বিভাগে বিভক্ত। প্রতিটি জেলার নিজস্ব জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় উন্নয়ন বোর্ড এবং জনগণের সমস্যা সমাধানে একটি কার্যকর কাঠামো রয়েছে। এই কাঠামোর সুফল পাওয়া যাচ্ছে স্থানীয় নির্বাচন, শিক্ষা প্রকল্প, স্বাস্থ্যসেবা বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়, যেখানে জেলার নিজস্ব প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
যদিও বর্তমানে ৬৪টি জেলা কার্যকরভাবে প্রশাসনিক কাঠামো পরিচালনা করছে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও স্মার্ট গভর্নেন্স প্রবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে হয়তো "উপজেলা-নির্ভর" আরও মাইক্রো-ম্যানেজমেন্ট কাঠামো গড়ে উঠতে পারে। তবে এই ৬৪ জেলার ভিত্তি রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের নিকটবর্তী শাসনব্যবস্থার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
প্রত্যেক জেলার রয়েছে আলাদা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রশাসনিক গুরুত্ব। এরা শুধু মানচিত্রের রেখা নয়—বরং বাংলাদেশের ইতিহাস, উন্নয়ন ও মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংযোগের জ্যান্ত দলিল। ৬৪ জেলা গঠনের এই দীর্ঘ ও তথ্যসমৃদ্ধ অভিযাত্রা বলেই আজকের বাংলাদেশ একটি দক্ষ, সক্রিয় ও জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।