ডেঙ্গু, করোনা, চিকুনগুনিয়াঃ ত্রিমুখী মহামারিতে দেশ

ডেঙ্গু, করোনা, চিকুনগুনিয়াঃ ত্রিমুখী মহামারিতে দেশ
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

এক নতুন স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি বাংলাদেশ। ডেঙ্গু, করোনা ভাইরাস এবং চিকুনগুনিয়া-- রোগ তিনটি একসঙ্গে দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ত্রিমুখী চাপ সৃষ্টি করেছে। বর্ষা মৌসুমের শুরু এবং মানুষের অসচেতনতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশজুড়ে জুলাইয়ের বর্তমান পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক।

উদ্বেগজনক ডেঙ্গু পরিস্থিতিঃ
চলতি বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। জুন মাস থেকে এর তীব্রতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে বর্তমান জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১৫ হাজার ৫০০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
তন্মধ্যে গুরুতর ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার এবং ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৪০ জন, যার মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বেশি।

রাজধানী ঢাকাতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ ক্রমশই বেড়ে চলেছে। সাথে বাড়ছে শয্যা সংকট, আইসিইউ বেডের অপ্রাপ্যতা এবং রক্তদানের মতো প্রয়োজনীয়তা স্বাস্থ্যসেবার সঙ্কট। দেশের সরকারি-বেসরকারি উভয় চিকিৎসা ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমের কারণে এডিস মশার প্রজনন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মশা নিধনে সিটি করপোরেশনগুলোকে আরও কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ফগিংয়ের পাশাপাশি লার্ভা ধ্বংসের উপর জোর দেওয়া, ড্রেন পরিষ্কার রাখা এবং নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালনা আবশ্যক। একই সাথে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বাড়ির আশেপাশে বা ছাদে জমে থাকা পানি দ্রুত সরিয়ে ফেলার উপরও জোর দিতে হবে যাতে এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করা যায়। 


কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও নতুন ওয়েভের ঝুঁকি বিদ্যমান:
দেশে আবারও করোনার প্রকোপ বেড়েছে। চলতি বছরের শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে ভ্যাক্সিন গ্রহণ করা সত্বেও উল্লেখযোগ্য হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ১১ জুলাই ২০২৫ তারিখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে প্রায় ২৫০ জন এবং ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বর্তমানে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন। আক্রান্তদের শরীরে ওমিক্রণসহ বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে বিভিন্ন জনসমাগমের কারণে কোভিড সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। নতুন ওয়েবের সম্ভাবনা তীব্র হচ্ছে।
ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রবেশ পথে স্ক্রিনিং জোরদার করা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের নমুনা পরীক্ষা অব্যাহত রয়েছে।

সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, মাস্ক ব্যবহার এবং বুস্টার ডোজ গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেছে, যাতে নতুন সংক্রমণ মোকাবেলা করা যায় এবং স্বাস্থ্য খাতের উপর অতিরিক্ত চাপ এড়ানো যায়।
এদিকে করোনা মহামারির পরে টিকাদান কর্মসূচিতে দেশের একটি বড় অংশকে টিকার আওতায় আনা হলেও, এখনো শহর-গ্রাম পর্যায়ের বেশ কিছু মানুষ এবং জনগোষ্ঠী টিকার বাইরে রয়েছে, যা সার্বিক ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।


চিকুনগুনিয়া’র প্রকোপ বাড়ায় সতর্কতা জরুরিঃ 
চলতি বছরের শুরু থেকে বর্তমান জুলাই, ২০২৫ পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও, ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৩০০ জন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছেন।

এর মধ্যে ঢাকার কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় কয়েকটি ক্লাস্টার দেখা গেছে, যেখানে একই পরিবারে একাধিক সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। চিকুনগুনিয়াও মূলত এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়, যা ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে তীব্র জ্বর, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা এবং র‍্যাশ অন্যতম। তাই মশা নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ যেমন মশারি, মশা তাড়ানোর স্প্রে ব্যবহার এবং দিনের বেলায়ও সতর্ক থাকা এই রোগ প্রতিরোধের প্রধান উপায়।

এই ত্রিমুখী সংকট দেশের স্বাস্থ্য খাতের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। হাসপাতালগুলোতে একদিকে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়, অন্যদিকে কোভিড-১৯ এবং চিকুনগুনিয়ার রোগীদের জন্যও আলাদা আইসোলেশন ও চিকিৎসা ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে ফলে অত্যধিক প্রেশারে কাজ করছেন চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীগণ। সংকট বাড়ছে চিকিৎসা সরঞ্জাম, ঔষধপত্র এবং হসপিটাল বেডের। বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবলের অভাব প্রকট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের সচেতনতা ও সহযোগিতা অপরিহার্য। মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া—এগুলোই এই ত্রিমুখী স্বাস্থ্য সংকট থেকে উত্তরণের প্রধান পথ।
একইসাথে, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি, গবেষণা ও উন্নয়নের উপর জোর দেওয়া এবং জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ানো দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ