শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা কোথায় হারাচ্ছে? শিক্ষা ব্যবস্থায় এক নির্মম প্রশ্ন

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব বহু বছর ধরে স্বীকৃত হলেও, এর বাস্তব প্রভাব নিয়ে আজও নানা বিতর্ক বিদ্যমান। পাঠ্যসূচিতে 'নৈতিক শিক্ষা' এক আলাদা অধ্যায় হিসেবে থাকলেও বাস্তব জীবন ও শিক্ষার্থীদের মননে এর প্রভাব কতটুকু পৌঁছাচ্ছে, তা নিয়েই চিন্তার কারণ রয়েছে। নৈতিক শিক্ষা হল এমন একটি শিক্ষা, যা কেবল পঠন-পাঠনের মাধ্যমে নয়, বরং জীবনচর্চার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির চরিত্র ও মূল্যবোধ গঠনে সহায়ক। সততা, সম্মান, দায়িত্ব, সহানুভূতি-এসব গুণাবলীর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী কেবল জ্ঞানের আলোয় উজ্জ্বল হয় না, সমাজের সৎ নাগরিক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
তবে, সাম্প্রতিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আজকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা অনেক সময় কেবল পাঠ্যবইয়ের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য একটি 'নম্বর আদায়' বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এতে শিক্ষার্থীরা নৈতিক শিক্ষাকে কেবল একটি তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবেই দেখে, যা পরীক্ষায় পাশ করার জন্য প্রয়োজন।
নৈতিক শিক্ষা কার্যকর করতে গেলে শুধুমাত্র বইয়ের মাধ্যমে পাঠ দেওয়া যথেষ্ট নয়। প্রাথমিকভাবে শিক্ষকের নিজস্ব নৈতিকতা ও আচরণ শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় উদাহরণ। যদি শিক্ষকরা তাদের কর্মজীবনে সততা, দায়িত্ব ও মানবিকতা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন, তবে শিক্ষার্থীদের মনে সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন হয় না।
অন্যদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক শিক্ষাকে জীবনের অংশ করে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে। যেমন, সামাজিক সেবামূলক কার্যক্রম, নৈতিক গল্পকথন, নাটক, ডিবেট, এবং বিভিন্ন আচরণগত মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিকতার বীজ বপন করার প্রচেষ্টা চলছে। এসব কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থীদের আত্মমর্যাদা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়াতে সহায়ক হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে।
তবে আজকের সময়ের চ্যালেঞ্জগুলিও কম নয়-টেকনোলজির বিস্তার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ এবং পারিবারিক ভাঙাচোরা পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের নৈতিক মানসিকতাকে দুর্বল করছে। এই সমস্ত সামাজিক ও মানসিক প্রেক্ষাপটকে বুঝে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারকে নৈতিক শিক্ষার ধারাকে জীবনের অভ্যাসে রূপান্তর করতে আরো সচেতন হতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৈতিক শিক্ষা কেবল একটি শিক্ষাবিষয় নয়, এটি একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা। শিক্ষার্থী যখন জীবনে তার শিক্ষা প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে, তখনই নৈতিক শিক্ষার আসল সফলতা গড়ে উঠবে। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষাবোর্ড, শিক্ষক, পরিবার ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
নৈতিক শিক্ষাকে শুধু একটি পরীক্ষার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করলে এর গুণগত ফলাফল পাওয়া যাবে না। এটি হতে হবে শিক্ষার্থীর জীবনের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এবং চরিত্র গঠনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাস্তব জীবনের নৈতিক দ্বন্দ্ব ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম করে তোলার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা সত্যিকারের নৈতিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। তাই নৈতিক শিক্ষা শুধু পাঠ্যসূচিতে নয়, বরং জীবনের অভিজ্ঞতা ও আচরণের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হতে হবে-এটাই হবে বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।