মেঘের ওপরে পাহাড়, আর নীরব জলরাশিতে নিমজ্জিত হাওর-বাংলাদেশের দুই চরম সীমা

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশ,যে দেশে নদী এবং জলাশয় দিয়ে তৈরি এক অবিরাম সবুজ ক্যানভাস, সেখানে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতার ভিন্নতা অনেকেরই অজানা। দেশের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভূ-প্রান্ত শুধু ভৌগোলিক তথ্য নয়, এটি বাংলাদেশের প্রকৃতির এক অপরূপ বৈচিত্র্যের গল্প। আসুন, এক নজরে জানি এই দুই চরম স্থান কোথায় অবস্থিত এবং কেন এরা বিশেষ।
আকাশের কাছে ছোঁয়া - সাজেকের কানপতি পাহাড়: রাঙ্গামাটির পার্বত্য অঞ্চল সাজেক উপত্যকার 'কানপতি পাহাড়' বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। আধুনিক ভূ-তাত্ত্বিক জরিপে এর উচ্চতা প্রায় ১,০৯৮ মিটার (৩,৬০২ ফুট)। অনেক সময় কেওক্রাডং কিংবা তাজিংডংকে সর্বোচ্চ বলে মনে করা হলেও, সঠিক পরিমাপে কানপতি পাহাড়ই এগিয়ে রয়েছে।
এই পাহাড়ের পরিবেশ অতুলনীয়। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চারদিকে মেঘের সমুদ্র দেখতে পাওয়া যায়। এখানে পাওয়া যায় বর্ণিল পাখি, বিরল গাছগাছালি ও জীববৈচিত্র্যের এক বিপুল ভাণ্ডার। দেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত গঠন বোঝার জন্য এই অঞ্চলের ভূ-তাত্ত্বিক ও জৈব বৈচিত্র্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পানির নিচে ডুবে থাকা - টাঙ্গুয়ার হাওরের নিচু ভূমি: অপর প্রান্তে রয়েছে দেশের সবচেয়ে নিচু স্থান, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। বর্ষাকালে এখানকার ভূমির অধিকাংশ অংশ জলমগ্ন হয়ে যায় এবং উচ্চতা মাত্র ২.৩৭ মিটার নীচে নেমে আসে। এই হাওর বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাভূমির অন্যতম বড় উদাহরণ।
টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু মাছ ধরার স্থান নয়, বরং বন্যার সময় এটি পানির সঞ্চালন ও মাটির উর্বরতার নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এখানকার পলি জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া, নদীভাঙন ও জমির গঠন দেশের ভূ-প্রকৃতির চলমান পরিবর্তনের এক বাস্তব ছবি।
কেন এই উচ্চতার পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ?
দেশের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভূ-প্রান্তের মধ্যে প্রায় ১,১০০ মিটার পার্থক্য রয়েছে। এই উচ্চতার ভিন্নতা শুধু ভূ-রূপ নয়, দেশের জলবায়ু, কৃষি, বনজ সম্পদ, বন্যপ্রাণী এবং মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
উচ্চ পাহাড়ি অঞ্চলের ঠাণ্ডা ও আর্দ্র পরিবেশ বনজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল গড়েছে, যেখানে নিচু জলাভূমির বর্ষার জলাধার ও নিত্য পরিবর্তনশীল মাটি কৃষিকাজের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভান্ডার।
ভৌগোলিক বিশ্লেষণ: বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠন মূলত প্লেট টেকটোনিক্সের ওপর নির্ভরশীল। ভারতের প্লেটের সঙ্গে ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষের ফলে পার্বত্য অঞ্চল গড়ে উঠেছে, যা সাজেক ও কানপতি পাহাড়ের উচ্চতা সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে, তিস্তা, যমুনা ও মেঘনা নদীগুলোর পলিমাটি জমা হওয়ার কারণে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ নিম্নভূমি গঠিত।
এই দুই অঞ্চলের মাটির গঠন, জলাধার ক্ষমতা, এবং তাপমাত্রার পার্থক্য দেশের জলবায়ু বৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির এই দুই চরম স্থান শুধু আকর্ষণীয় ভৌগোলিক তথ্য নয়, দেশের পরিবেশ, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সোপান। আকাশের ছোঁয়া 'কানপতি পাহাড়' থেকে শুরু করে পানির মাঝে ডুবে থাকা 'টাঙ্গুয়ার হাওর'-দুটি স্থান আমাদের শেখায়, দেশের প্রকৃতি কতটা বৈচিত্র্যময় ও অদ্ভুত।
এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি, ভূ-প্রকৃতির এই পার্থক্য মাটির জীবন, মানুষের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ওপর কতটা গভীর প্রভাব ফেলে। তাই বাংলাদেশের এই দুই চরম ভৌগোলিক স্থান গবেষণা ও সংরক্ষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।