ফল নয়, যেন অর্থনীতির ইঞ্জিন-জেনে নিন কোথায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয় কোন ফলের

ফল নয়, যেন অর্থনীতির ইঞ্জিন-জেনে নিন কোথায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয় কোন ফলের
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাংলাদেশের অতি প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে গাঁথা রয়েছে এর উর্বর মাটি আর জলবায়ুর বৈচিত্র্য, যা ফল উৎপাদনের জন্য অনন্যভাবে উপযোগী। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতে ফলের বিভিন্ন প্রকার চাষ হয়, তবে ভূগোল ও জলবায়ুর পার্থক্যের কারণে ফলের ধরন ও উৎপাদন ক্ষমতায় বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। ফল শুধু পুষ্টি সরবরাহ করে না, দেশের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশও এটি, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে। এবার বিস্তারিতভাবে জানা যাক, বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে কী ফল বেশি চাষ হয় এবং কেন সেই অঞ্চলগুলি সেই ফলের জন্য উপযুক্ত।

আমের রাজধানী- রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ: বাংলাদেশে আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। পদ্মার বালুকাময় তীরবর্তী এই অঞ্চলের মাটি খুবই উর্বর এবং এখানে শীতল ও গ্রীষ্মের তাপমাত্রার পার্থক্য আমের মিষ্টতা ও রঙ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া জাতের আমের ব্যাপক চাষ এখানে হয়, যা দেশের মোট আম উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকের বেশি। এই অঞ্চলের আম বিশ্ববাজারেও সরাসরি রপ্তানি হয়।
 

কাঁঠালের বাণিজ্য কেন্দ্র - নরসিংদী ও গাজীপুর: বাংলাদেশে কাঁঠাল চাষের ক্ষেত্রে নরসিংদী ও গাজীপুর জেলায় সাফল্য লক্ষণীয়। এখানকার আর্দ্রতা, গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা এবং মাটির গঠন কাঁঠালের দ্রুত বৃদ্ধি ও ভালো ফলন নিশ্চিত করে। মে-জুন মাসে এই অঞ্চলে কাঁঠালের বিপুল পরিমাণ বাজারজাত হয়, যা দেশের কাঁঠাল চাহিদার বড় অংশ পূরণ করে। বাণিজ্যিক দিক থেকেও এই অঞ্চলটি দেশের প্রধান কাঁঠাল সরবরাহকারী।
 

লিচুর মধুরতা - দিনাজপুর ও পাবনা: উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলার লিচু চাষ একটি পরিচিত বিষয়। বিশেষ করে গুটি ও বেদানা জাতের লিচু এ অঞ্চলে অধিক প্রচলিত, যা দেশের বাজারে বড় চাহিদা তৈরি করে। পাবনা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলেও লিচু চাষ বাড়ছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রার ফারাক ও বেলে-দোআঁশ মাটি লিচু চাষের জন্য আদর্শ পরিবেশ প্রদান করে।
 

কলার বাণিজ্যিক উৎপাদন কেন্দ্র - চাঁদপুর ও কুমিল্লা: 

কলার ব্যাপক চাষ হয় চাঁদপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা অঞ্চলে। বাংলাদেশে কলার চাহিদা সারা বছরই থাকে, তাই এখানে বার্ষিক উৎপাদন অনেক বেশি। বিশেষ করে 'বঙ্গমালা' জাতের কলা অধিক জনপ্রিয় এবং এর উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ এ অঞ্চলগুলোর অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
 

পেয়ারা চাষের ভাসমান বাজার - বরিশাল ও পিরোজপুর: 

বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি অঞ্চলে পেয়ারার চাষ ও বাজারজাতকরণ ভিন্ন মাত্রার। এখানকার গ্রামগুলোতে খালবেষ্টিত পরিবেশে নৌকায় পেয়ারার লেনদেন হয়, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। দেশের মোট পেয়ারা উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এই দক্ষিণাঞ্চল থেকে। এখানে প্রচলিত পেয়ারা জাতগুলো উচ্চমানের ও সুস্বাদু বলে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
 

সাইট্রাস ফলের বাড়ন্ত সম্ভাবনা - সিলেট, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি: 

সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় লেবু, মাল্টা, কমলা চাষে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। পাহাড়ি মাটির অম্লীয়তা এবং উচ্চ আর্দ্রতা সাইট্রাস ফলের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। ফলে, এই ফলগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন গ্লোবাল ওয়র্মিং ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ফলের মৌসুম এবং উৎপাদনে ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলছে। সেচ ব্যবস্থা, রোগ প্রতিরোধ, আধুনিক প্রজাতি উন্নয়ন এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিন দিন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টায় ফলচাষে নতুন মাত্রা যোগ করা সম্ভব।

বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল যেন একটি নিজস্ব ফলের পরিচয় বহন করে। আমের মিষ্টতা রাজশাহীতে, কাঁঠালের স্বাদ গাজীপুরে, লিচুর মায়া দিনাজপুরে, কলার সম্পদ চাঁদপুরে, আর পেয়ারা নিয়ে ভাসমান বাজার গড়ে উঠেছে বরিশালে। দেশের এই ফলচাষের বৈচিত্র্য ও সম্ভাবনাকে সামনে রেখে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ফল উৎপাদনশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। কৃষি-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়েই এই সাফল্য অর্জন সম্ভব।


সম্পর্কিত নিউজ