এক দশকে পাল্টে গেল শিক্ষা গ্রহণের ধরণ, নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপ

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
গত দশকে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতেও এসেছে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন। শিক্ষা ও প্রযুক্তির মিলনে যে নতুন ক্ষেত্রটি আবির্ভূত হয়েছে, তা হলো EdTech বা এডুকেশন টেকনোলজি। এই খাতে উদ্ভাবন এবং নতুন ধারণার আগমন শিক্ষার পরিধিকে শুধু শহরকেন্দ্রিক থেকে গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত বিস্তার করছে, পাশাপাশি শেখার অভিজ্ঞতাকেও পরিণত করছে আরও বেশি ব্যক্তিগতকৃত ও কার্যকরী।
এডটেক স্টার্টআপের উত্থান: নতুন যুগের শিক্ষাদাতা
গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে অনলাইন শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে বহুগুণ। এই সময়ে উদ্ভাবনী এডটেক স্টার্টআপগুলো শিক্ষাকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অনলাইন লার্নিং, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, মোবাইল অ্যাপস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)-ভিত্তিক শেখার ব্যবস্থা—এসব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি হয়েছে এক সম্পূর্ণ নতুন শেখার পরিবেশ।
শিক্ষার ব্যক্তিগতকরণ ও প্রযুক্তি
প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতিতে একই পাঠ, একই গতি, একই ধরণের প্রশ্ন সবাইকে দিতে হত, যা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত চাহিদার সাথে মিলত না। তবে আধুনিক এডটেক প্ল্যাটফর্মগুলো অ্যালগরিদমের সাহায্যে শিক্ষার্থীর শেখার গতিবিধি ও দুর্বলতাগুলো বিশ্লেষণ করে নিজস্ব কনটেন্ট সাজায়। ফলে শিক্ষার্থী নিজস্ব গতিতে, নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে।
কিছু এডটেক প্ল্যাটফর্ম এখন শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও ক্যারিয়ার লক্ষ্য বিবেচনা করে কোর্স সাজানোর সেবা দেয়, যা শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা ও ব্যবহারিকতাকে বাড়িয়ে তোলে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নতুন সম্পর্ক
প্রযুক্তি কেবল শিক্ষার্থীকে সাহায্য করছে না, শিক্ষককেও উপকৃত করছে। শিক্ষকরা এখন ডিজিটাল টুল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে পারছেন আরও সহজে। এক্ষেত্রে শিক্ষক হয়ে উঠছেন 'গাইড' এবং 'মেন্টর', যাঁরা ছাত্রদের শেখার পথে প্রেরণা যোগাচ্ছেন। ভার্চুয়াল ফিডব্যাক সিস্টেম, গ্রুপ ডিসকাশন ফোরাম, লাইভ সেশন ইত্যাদি শিক্ষকদের এবং শিক্ষার্থীদের সংযোগকে করেছে আরও ঘনিষ্ঠ ও ফলপ্রসূ।
ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি: শিক্ষা সবার জন্য
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার ডিজিটালীকরণ মানে শুধু শহরের শিক্ষার্থী নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশু ও যুবক-কিশোরদেরও শিক্ষা অর্জনের সুযোগ বৃদ্ধি। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তারে 'ডিজিটাল বিভাজন' ধীরে ধীরে কমে আসছে। গ্রামীণ এলাকাতেও এখন শিক্ষার্থীরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে লাইভ ক্লাস, ভিডিও টিউটোরিয়াল এবং ইন্টার্যাকটিভ কুইজে অংশ নিতে পারছে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
তবে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষায় কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্কের সমস্যা, সঠিক ডিভাইসের অভাব এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার ঘাটতি এখনও বড় বাধা। এছাড়া শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক আপডেট এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যক।
গবেষণা ও পরিসংখ্যানের আলোকে
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে, উন্নত এডটেক ব্যবহার শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফলে গড়ে ২০-৩০ শতাংশ উন্নতি ঘটায়। শিক্ষার্থীর শেখার আগ্রহ ও ধারাবাহিকতা বৃদ্ধি পায়। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এডটেক বাজার বছরে প্রায় ১৫-২০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের অংশও দ্রুত বাড়ছে।
এডটেকের ভবিষ্যত: এক নতুন শিক্ষা সংস্কৃতি
আগামী দিনে শিক্ষা হবে কেবল পাঠ্যবই কিংবা শ্রেণিকক্ষে আটকে থাকা না, বরং হবে বহুমাত্রিক, বহুভাষিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (VR) ও অগমেন্টেড রিয়ালিটি (AR) ব্যবহার করে বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়গুলোর বাস্তব অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীরা পাবে। এআই চালিত চ্যাটবট ও ব্যক্তিগত শিক্ষণ সহকারী শিক্ষার সাথে প্রতিনিয়ত সঙ্গী হয়ে উঠবে।
এডটেক স্টার্টআপগুলোর এই উদ্ভাবনী যাত্রা শুধুমাত্র শিক্ষার উন্নয়নই নয়, বরং একটি শিক্ষানবীণ জাতি গঠনের ভিত্তি স্থাপন করছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে এদের ভূমিকা হবে অমূল্য।
শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর এখন সময়ের দাবি। প্রযুক্তিনির্ভর এডটেক স্টার্টআপ শিক্ষাকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করছে, শেখার গুণগত মান বাড়াচ্ছে এবং নতুন যুগের শিক্ষার পথ সুগম করছে। এই পরিবর্তনের ধারাকে অব্যাহত রেখে সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য শিক্ষার এক নতুন ও শক্তিশালী পরিকাঠামো গড়ে ওঠে।