স্মার্ট সেন্সর থেকে স্যাটেলাইট: প্রযুক্তির চোখে দুর্যোগের আগাম বার্তা

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বিশ্বজুড়ে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস কিংবা ভূমিকম্প-মানুষের জীবন ও অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশে এই বিপর্যয় প্রতিবারই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি বয়ে আনে। তবে আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে এই দুর্যোগ মোকাবেলা কেবল রকমারি প্রস্তুতি আর দুর্ভিক্ষের সময় অপেক্ষা নয়; এটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, তথ্য-চালিত প্রক্রিয়া যা আগাম সতর্কবার্তা ও দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রমকে মেলে ধরে।
আগাম পূর্বাভাস: উপগ্রহ প্রযুক্তি, আবহাওয়া স্টেশন, ভূমিকম্প সেন্সর, এবং আধুনিক স্যাটেলাইটের সমন্বয়ে পৃথিবীর আবহাওয়া ও ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতি প্রায় রিয়েল-টাইমে পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার প্রভাব যথাযথ পূর্বাভাস দিয়ে মানুষকে প্রস্তুত করতে সক্ষম হচ্ছে এই প্রযুক্তি। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ডেটা বিশ্লেষণ করে ঝড়ের গতিপথ, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, নদীর পানি বৃদ্ধির মাত্রা ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহারে পূর্ববর্তী তথ্য থেকে ভবিষ্যতের দুর্যোগের আকার ও সময় নির্ধারণ আরও নিখুঁত হচ্ছে। ফলে সরকারি ও স্থানীয় প্রশাসন ঠিক সময়ে জনসাধারণকে সতর্ক করতে পারে, জরুরি ব্যবস্থা নিতে পারে।
উদ্ধারে প্রযুক্তির বহুমুখী অবদান- দুর্যোগের পরে উদ্ধার কাজের সময় বেঁচে থাকা প্রাণ উদ্ধারই সবার মূল লক্ষ্য। এখানে রোবোটিক্স, ড্রোন, ও তথ্যভিত্তিক ম্যাপিং প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দ্রুত পৌঁছে পরিণতি পর্যালোচনা করতে, নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান করতে ড্রোনগুলো কাজ করছে। জিআইএস (GIS) ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও বিপজ্জনক স্থানের সঠিক অবস্থান পাওয়া যায়, যা উদ্ধারকর্মীদের জন্য কার্যকর হাতিয়ার। মোবাইল অ্যাপস ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে জরুরি তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা প্রতিটি নাগরিককে সচেতন ও সুরক্ষিত রাখছে।
IoT ও স্মার্ট সেন্সর: দুর্যোগের প্রতিটি মুহূর্ত নজরে- ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) এর মাধ্যমে নদী, সেতু, বাঁধ, বনাঞ্চলসহ বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত স্মার্ট সেন্সর দুর্যোগের সম্ভাব্য সঙ্কেত সংগ্রহ করছে। পানি স্তরের ওঠানামা, মাটি ঝরার সম্ভাবনা, বাতাসের গতি–এ সব তথ্য অনলাইনে পাঠানো হয়, যা কেন্দ্রীয় কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করে দ্রুত সতর্কতা জারি করা হয়। বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণে এখন এ ধরনের সেন্সর নেটওয়ার্ক অনেকাংশে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে সময়মতো নৌকা, খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
তথ্য ও প্রযুক্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নতুন সম্ভাবনার দরজা - প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু দুর্যোগের আগে সতর্কতা ও পরে উদ্ধার কাজ সীমাবদ্ধ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন পরিকল্পনাতেও এটি অপরিহার্য। ডিজিটাল ম্যাপিং, ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন (DRR) মডেল ও জনসংখ্যা তথ্যের সমন্বয়ে পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিকল্পিত ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হচ্ছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ এবং প্রযুক্তির দায়িত্ব- দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, তা সফল হতে পারে কেবল সঠিক ব্যবস্থাপনা, জনসচেতনতা এবং দুর্যোগ প্রশমন নীতির সঙ্গে সমন্বয়ে। প্রযুক্তির মাধ্যমে আগাম সতর্কতা পাওয়া গেলেও জনগণ যদি সঠিক সময়ে প্রতিক্রিয়া না দেয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমানো কঠিন। এ জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তি ও মানবসম্পদের সঠিক মেলবন্ধন, আর নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও জনমাধ্যমের মাধ্যমে সঠিক তথ্য পরিবেশন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ আজও পৃথিবীর বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ জীবন বাঁচাতে পারে, ক্ষতি কমাতে পারে। বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে 'আগাম সতর্কবার্তা' এবং 'দ্রুত উদ্ধার ব্যবস্থা' নিশ্চিত করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। প্রযুক্তির স্মার্ট চোখ যখন সতর্কতা জাগাবে, তখন জনজীবন ও অর্থনীতির সুরক্ষা নিশ্চিত হবে আরও শক্তিশালীভাবে।
এই দিকেই এগিয়ে চলছে মানবতা ও প্রযুক্তির যুগান্তকারী অংশীদারিত্ব।