মহাকাশে মানবদেহের পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সমস্যা

মহাকাশে মানবদেহের পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সমস্যা
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন আজ বাস্তব, কিন্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে গিয়ে মানবদেহের অবস্থা এমন নয় যা আমরা সহজে কল্পনা করতে পারি। শূন্য ওজনের পরিবেশে মানুষ যেমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, তেমনি তার শরীরেও ঘটে গম্ভীর পরিবর্তন, যা বিজ্ঞানীদের সামনে এখনও চ্যালেঞ্জ। আধুনিক গবেষণার আলোকে দেখা যাক, মহাকাশে মানুষের

শরীরের এই অদ্ভুত ও জটিল রূপান্তরগুলো কী কী।

১. হাড়ের ক্ষয়: মাধ্যাকর্ষণের অভাবে দুর্বলতা

পৃথিবীতে আমাদের হাড় নিয়মিত মাধ্যাকর্ষণের চাপ সামলে কাজ করে। কিন্তু মহাকাশে ওজনহীনতায় এই চাপ না থাকার ফলে হাড়ের মধ্যে থাকা খনিজ পদার্থ দ্রুত হারিয়ে যায়। প্রতি মাসে প্রায় ১% থেকে ১.৫% হাড়ের ঘনত্ব কমতে পারে, বিশেষ করে মেরুদণ্ড, হাঁটু ও কাঁধের অংশে। এর ফলে মহাকাশচারীরা ভূতলে ফিরে আসার পর হাড় ভঙ্গুরতা ও ফ্র্যাকচারের ঝুঁকিতে পড়েন। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা হাড় ক্ষয় রোধে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বিশেষ ব্যায়াম ও ঔষধ প্রয়োগের ওপর কাজ করছেন।
 

২. পেশির ক্ষয়: শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতার হ্রাস

মাধ্যাকর্ষণের অভাবে পেশি কম ব্যবহৃত হয়, ফলে মাস্টারোপিয়া তথা পেশির সংকোচন কমে যায়। মহাকাশচারীরা দীর্ঘ সময় শূন্য মাধ্যাকর্ষণে থাকার ফলে তাদের পেশির শক্তি প্রায় ২০-৩০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বিশেষ করে পিঠ ও পায়ের পেশি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই মহাকাশে নিয়মিত ভারসাম্য ও শক্তি বৃদ্ধির ব্যায়াম করানো হয়, যাতে শরীরের পেশি টিকে থাকে।
 

৩. রক্তচাপ ও রক্ত সঞ্চালনে পরিবর্তন

মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় রক্ত শরীরের নিচের অংশ থেকে উপরের দিকে সরে যায়, যার কারণে মাথায় রক্তের চাপ বাড়ে। এর প্রভাব পড়ে চোখের রেটিনায়, যা "স্পেসফ্লাইট অ্যাসোসিয়েটেড নিউরো-অপ্থালমোপ্যাথি" নামে পরিচিত। অনেক নভোচারী দীর্ঘমেয়াদি মিশনে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হওয়া বা কমে যাওয়া অনুভব করেন। এ ছাড়া রক্তের পরিমাণ সাময়িকভাবে কমে যাওয়ার কারণে শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়।
 

৪. মেরুদণ্ডের প্রসারণ: অস্থিরতা ও ব্যথার কারণ

মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ না থাকার ফলে মেরুদণ্ডের কশেরুকাগুলোর মধ্যে থাকা ডিস্কগুলো প্রসারিত হয়ে যায়, যার কারণে মহাকাশচারীদের শরীর গড়ে ২-৩ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। যদিও পৃথিবীতে ফিরে আসার পরে এই বৃদ্ধি আবার কমে যায়, তবে এর ফলে পিঠে ব্যথা ও অস্থিরতা বেড়ে যায়, যা বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি করে।
 

৫. মানসিক চাপ ও ঘুমের ব্যাঘাত

মহাকাশের নিঃসঙ্গ পরিবেশ, পৃথিবীর স্বাভাবিক চক্র থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং অবিরাম কাজের চাপের কারণে ঘুমের সমস্যা এবং মানসিক চাপ বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন মহাকাশে থাকার ফলে নিঃসঙ্গতা, উদ্বেগ ও অবসাদ দেখা দিতে পারে, যা মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। আধুনিক মহাকাশ মিশনে এ ধরনের মানসিক চাপ মোকাবেলার জন্য সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট সিস্টেম ও ভার্চুয়াল যোগাযোগ ব্যবস্থাও যুক্ত হয়েছে।
 

৬. ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়া

মহাকাশে মানুষের ইমিউন সিস্টেম অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। স্ট্রেস, ব্যাকটেরিয়ার পরিবর্তিত প্রকৃতি এবং শরীরের জৈবিক পরিবর্তনের কারণে শরীর স্বাভাবিকের মতো সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। তাই মহাকাশ অভিযানে স্বাস্থ্য রক্ষা ও সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হয়।
 

ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়

মহাকাশে মানবদেহের উপর পড়া এসব প্রভাব আমাদের ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযান এবং বহুগুণ দীর্ঘস্থায়ী দূরন্ত মিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মঙ্গল মিশনের মতো দীর্ঘ সময়ের মহাকাশ ভ্রমণে এসব শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা জরুরি। শরীর ও মন দুটোই যেন নতুন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করাই আগামী দিনের মহাকাশ অভিযানের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।

সংক্ষেপে বলা যায়, মহাকাশে থাকা মানে শুধু নতুন দুনিয়ায় যাওয়া নয়, এটি মানবদেহের এক বৃহৎ পরীক্ষাগার যেখানে বিজ্ঞানীরা জীববিজ্ঞানের নতুন সীমা স্পর্শ করছেন। এই গবেষণাই একদিন দূর গ্রহে মানুষের নিরাপদ বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করবে।


সম্পর্কিত নিউজ