বাংলাদেশের নদীমাতৃক ঐতিহ্য ও জলবায়ুর পরিবর্তন

বাংলাদেশের নদীমাতৃক ঐতিহ্য ও জলবায়ুর পরিবর্তন
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাংলাদেশের পরিচয়- নদীর দেশ। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের বিশাল জোড়া নদী বাংলার মাটিকে সমৃদ্ধ করেছে, হাজার বছরের ইতিহাসের ধারায় জীবন দিয়েছে অসংখ্য মানুষের। নদী শুধু পরিবহন ও সেচের মাধ্যমই নয়, বরং এটি এই দেশের কৃষি, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সামাজিক জীবনের প্রাণশক্তি।

তবে, আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক হুমকি-জলবায়ু পরিবর্তন-বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূখণ্ডকে বিপদের মুখে নিয়ে এসেছে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিপোর্ট বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, যেখানে নদীর প্রবাহের বৈপরীত্য ও জলবায়ুর ওঠানামা দেশকে চরম সংকটে ফেলেছে।
 

নদীর প্রবাহ ও জলবায়ুর অস্থিরতা- পাহাড় থেকে নেমে আসা গলিত বরফের প্রবাহে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। গ্রীষ্মের সময় বরফ গলনের দ্রুততা বেড়ে নদীগুলোতে অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হচ্ছে, যার ফলে বন্যা ঝুঁকি বাড়ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি কমে যাচ্ছে, যা সেচ ও জীবনধারণে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের কৃষকেরা এখন নিয়মিত পানির সংকট মোকাবেলা করছেন।

বর্ষাকালে আগের মতো সঠিক সময়ে ও পরিমাণে বৃষ্টি না হওয়ায় খরা ও অতিবৃষ্টির বিরূপ প্রভাব বেড়ে চলেছে। এই পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের ধরণ নদীর জলস্তর নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, যা জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য আহরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
 

লবণাক্ততার ভয়াবহতা- উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে লবণাক্ততা প্রবেশ করেছে অনেকদূর। এর ফলে ঘরোয়া পানির সংকট, মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া ও মাছ চাষে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কৃষকেরা এখন লবণ প্রতিরোধী ফসল চাষে বাধ্য হচ্ছেন, যা আর্থিক ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।
 

নদীভাঙন ও জলবায়ু উদ্বাস্তু- নদীভাঙন গত কয়েক বছরে তীব্র রূপ নিয়েছে। প্রতিবছর হাজার হাজার পরিবার তাদের বসতভিটা হারিয়ে অন্যত্র স্থানান্তর করতে বাধ্য হচ্ছেন। বগুড়া, নীলফামারী, নেত্রকোনা সহ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে নদী ভাঙনের ফলে জমি ও বসতসংকট দিন দিন বাড়ছে। জলবায়ুর প্রভাবে এই সমস্যা আরো জটিল হয়ে উঠেছে, কারণ অতিবৃষ্টিতে নদী তীর ভেঙে নতুন নতুন এলাকা ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা এক কোটির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ভয়াবহ সংকেত।
 

পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব- নদী কমে যাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে মৎস্যশিল্পে হ্রাস, কৃষিতে ফলন কমে যাওয়া ও পানীয় জলের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এ কারণে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ ভারসাম্য বিপন্ন হচ্ছে। নদী হারালে শুধু মাটি নয়, হারাবে বহু প্রজাতির জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ, যা নদীর সাথে জীববৈচিত্র্যের গাঁথা অমোঘ বন্ধন।
 

জলবায়ু অভিযোজন ও নদী রক্ষায় করণীয়- বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও স্থানীয় জ্ঞানের সমন্বয়ে নদী ব্যবস্থাপনা জরুরি। নদীর প্রবাহ ও তীর রক্ষার জন্য প্রাকৃতিক সেচব্যবস্থা উন্নয়ন, ড্রেজিং, বৃক্ষরোপণ, ও পলিবাগান বৃদ্ধির মাধ্যমে নদীর চর ও তীর সংরক্ষণে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে জলবায়ু অভিযোজন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করতে হবে।

সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা, একাডেমিয়া ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে জলবায়ু প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন, যা নদী, কৃষি ও জনজীবনের সমন্বিত সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।

নদী বাংলাদেশের রক্তসঞ্চার। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবেলায় নদীকে রক্ষা করা মানেই দেশের অস্তিত্ব রক্ষা করা। একসাথে কাজ করলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শক্তি দিয়ে নদীর জীবন আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। নইলে নদীর বুকে হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের সবুজ প্রাণ।


সম্পর্কিত নিউজ