কাগজের ঘ্রাণ না স্ক্রিনের জাদু: শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ও পঠনপ্রক্রিয়ার যুগান্তকারী দ্বন্দ্ব

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মাধ্যম হিসেবে ছাপানো বই এবং ই-বুকের জনপ্রিয়তা নিয়ে চলছে তীব্র আলোচনা। প্রযুক্তির বিকাশের ফলে ই-বুক দ্রুত জনপ্রিয় হলেও, প্রথাগত ছাপানো বই এখনও শিক্ষার্থীদের মধ্যে শক্ত অবস্থান বজায় রেখেছে। প্রশ্ন হলো-কোন মাধ্যম শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে এবং জ্ঞান গ্রহণে বেশি কার্যকর?
একদিকে, ছাপানো বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানোর স্পর্শ এবং কাগজের স্বতন্ত্র গন্ধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বিশেষ সংযোগ তৈরি করে। এই সংযোগ মনোযোগ বৃদ্ধি করে এবং স্মৃতি ধরে রাখতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বইয়ের ছাপানো পৃষ্ঠায় লেখা পড়ার সময় চোখের ফোকাস ও ব্রেনের প্রক্রিয়া ই-বুকের তুলনায় আলাদা ও বেশি কার্যকর। কাগজের বই পড়া মানে শুধুমাত্র তথ্য গ্রহণ নয়, বরং এক ধরণের সংবেদনশীল অভিজ্ঞতা, যা শেখার গভীরতা বৃদ্ধি করে।
অন্যদিকে, ই-বুক দ্রুত এবং বহুমাত্রিক সুবিধা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করে। এক্ষেত্রে অ্যাডজাস্টেবল ফন্ট সাইজ, শব্দ অনুসন্ধান, নোট গ্রহণ এবং মাল্টিমিডিয়া ফিচার শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে দূরবর্তী শিক্ষায় ই-বুকের ভূমিকা অপরিসীম। যদিও স্ক্রিনে দীর্ঘক্ষণ পড়ার ফলে চোখে ক্লান্তি ও মনোযোগ বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা থাকে, তবে যথাযথ বিরতি এবং পরিমিত ব্যবহারে এ সমস্যাগুলি কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উপর করা সাম্প্রতিক সমীক্ষায় পাওয়া গেছে, উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ এখনও পরীক্ষা প্রস্তুতিতে ছাপানো বইকে বেশি কার্যকর মনে করেন। কারণ, তারা অনুভব করেন যে ছাপানো বইয়ের মাধ্যমে পড়াশোনায় মনোযোগ এবং স্মৃতি শক্তি আরও ভালোভাবে কাজ করে। তবে প্রযুক্তিতে দক্ষ শিক্ষার্থীরা দ্রুত তথ্য অনুসন্ধান ও বহুমাত্রিক শিক্ষণ উপকরণ পাওয়ার কারণে ই-বুককে বেশি সুবিধাজনক মনে করছেন।
এছাড়া মনোযোগ সংক্রান্ত মানসিক ও শারীরিক দিক থেকেও গবেষকরা বলছেন, কাগজের বই পড়ার সময় মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রে ব্রেনের আলাদা কার্যপ্রণালী সক্রিয় হয়, যা ডিজিটাল স্ক্রিন থেকে পড়ার সময় হয় না। স্ক্রিনের ফ্লিকার, ব্লু লাইট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞপ্তি মনোযোগ বিঘ্নিত করে।
তবে ই-বুকের সুবিধাও অনস্বীকার্য। বিশেষ করে ই-বুক শিক্ষার্থীদের মধ্যে বহনযোগ্যতা, পরিবেশবান্ধবতা এবং ব্যয় সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এছাড়াও, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য ই-বুকের টেক্সট টু স্পিচ এবং আকার পরিবর্তন করার সুবিধা তাদের পড়াশোনাকে অনেক সহজ করেছে।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে ছাপানো বই ও ই-বুকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব কেবল প্রযুক্তি ও প্রথার লড়াই নয়; এটি শিক্ষার প্রক্রিয়া ও গ্রহণযোগ্যতার গভীর বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন। কাগজের বইয়ের স্পর্শ ও গন্ধ এখনও মনোযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ, আর ই-বুকের বহুমুখী সুবিধা আধুনিক শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত অভ্যাস, পরিবেশ এবং প্রযুক্তি গ্রহণযোগ্যতার ওপর নির্ভর করে দুই মাধ্যমের যেকোনো একটিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
সুতরাং, শিক্ষা ক্ষেত্রে কার্যকর ও ফলপ্রসূ পঠন উপকরণ নির্বাচন করতে হলে, প্রযুক্তিগত সুবিধা ও মানবিক সংবেদন দুইয়ের সঙ্গেই সমন্বয় করতে হবে। যেকোনো মাধ্যমই হোক, শিক্ষার্থীর মনোযোগ ও জ্ঞান আহরণের ওপর তার প্রভাবই সর্বাগ্রে বিবেচ্য।