আগ্নেয়গিরির উত্তাপে কীভাবে নরকে রূপ নিল 'দ্বিতীয় পৃথিবী'?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
এক সময় বিজ্ঞানীদের কল্পনায় ভেনাস ছিল এক সম্ভাবনাময় গ্রহ-আকারে পৃথিবীর কাছাকাছি, অবস্থানেও অনুরূপ। তাই তাকে বলা হতো "Earth's Twin" বা পৃথিবীর জমজ। কিন্তু আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। ভেনাস এখন সৌরজগতের সবচেয়ে বিপজ্জনক গ্রহগুলোর একটি-একটি উত্তপ্ত, বিষাক্ত, এবং মৃতপ্রায় জগৎ। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে এক ভয়ঙ্কর ভূ-প্রক্রিয়া-অগ্ন্যুৎপাত।
সক্রিয় আগ্নেয়গিরি: মহাকাশে একটি অস্বাভাবিক দৃশ্য
সাম্প্রতিক নাসার ম্যাগেলান মিশন থেকে পাওয়া রাডার ইমেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভেনাসে এখনও সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে। ২০২৩ সালের একটি বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে একটি আগ্নেয়গিরির মুখের গঠন মাত্র আট মাসের ব্যবধানে পরিবর্তিত হয়েছে, যা সরাসরি জিওলজিক্যাল অ্যাকটিভিটির প্রমাণ।
মোট অনুমান করা হচ্ছে-ভেনাসে প্রায় ১,৬০০টিরও বেশি আগ্নেয়গিরি রয়েছে, যার মধ্যে শতাধিক হতে পারে সক্রিয়। এসব আগ্নেয়গিরির মধ্য দিয়ে বের হওয়া ম্যাগমা ও গ্যাস গ্রহের বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিবর্তন এনেছে-বিশেষ করে সালফার ডাইঅক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা অতিমাত্রায় বেড়েছে, যা তৈরি করেছে এক জটিল গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া।
কীভাবে আগ্নেয়গিরি বদলে দিল গ্রহের ভাগ্য?
প্রাথমিক পর্যায়ে ভেনাসের বায়ুমণ্ডলে পানির উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, যার ইঙ্গিত দেয় যে এটি একসময় তুলনামূলকভাবে বসবাসযোগ্য ছিল। কিন্তু বিস্তৃত আগ্নেয়গিরি কার্যকলাপ ধীরে ধীরে সেই সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়। বড় বিস্ফোরণগুলো থেকে নির্গত গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ঘন কার্বন-আচ্ছাদন তৈরি করে, সূর্যের তাপ আটকে ফেলে, ফলে ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে গ্রহের তাপমাত্রা। এক সময় পানির অস্তিত্ব হারিয়ে যায়। সালফিউরিক অ্যাসিডযুক্ত ঘন মেঘ আচ্ছাদিত করে দেয় গোটা আকাশ।
ভেনাসের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ৯০ গুণ বেশি। আর এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা যথেষ্ট যে সীসা গলিয়ে ফেলে। এই অতি উষ্ণতা এবং চাপ একসাথে মিলে গঠন করেছে এমন এক পরিবেশ, যেখানে জীবনের কোনও চিহ্নের টিকে থাকা কার্যত অসম্ভব।
পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কি ভেনাসের ছায়ায় ঢাকা?
বিশেষজ্ঞরা একে বলছেন "Runaway Greenhouse Effect"-যেখানে গ্রহের নিজস্ব তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এক সময় হারিয়ে যায়, এবং তারপরে তা একদিকেই গড়িয়ে পড়ে। ভয়ঙ্কর বাস্তবতা হলো, পৃথিবীতেও অনিয়ন্ত্রিত শিল্প কার্যক্রম এবং কার্বন নির্গমনের ফলে আমরা ধীরে ধীরে একই পথেই হাঁটছি।
ভেনাস আমাদের সামনে এক বিজ্ঞানভিত্তিক ভবিষ্যৎ চিত্র তুলে ধরছে-যদি আমরা কার্বন নির্গমন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের লাগাম না টানি, তাহলে পৃথিবীর গতি ভেনাসমুখী হওয়াটা শুধু কল্পনা নয়, এক সম্ভাব্য বাস্তবতা।
ভেনাসের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ কেবল তার মাটি নয়, সময়ের সঙ্গে পাল্টে দিয়েছে তার পরিবেশ, বায়ুমণ্ডল ও সম্ভাব্য জীবনকে। এটি এখন আমাদের কাছে এক জীবন্ত গবেষণাগার-যেখান থেকে আমরা শিখতে পারি কীভাবে একটি বসবাসযোগ্য গ্রহ তার ভারসাম্য হারিয়ে হয়ে উঠতে পারে অস্থির ও ভয়াবহ। মহাকাশের এই আগ্নেয়গ্রহ হয়তো ভবিষ্যতের পৃথিবীকে আগাম সতর্ক বার্তা দিচ্ছে-প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা না করলে আমরা নিজেরাই নিজের পৃথিবীকে ভেনাসে পরিণত করবো।