মহাকাশ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
পৃথিবীর বুকে জলবায়ু পরিবর্তনের আলামত যতটা চোখে পড়ছে, তার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর চিত্র উঠে আসছে পৃথিবীর বাইরে-মহাকাশ থেকে। আজকের বিশ্বে বিজ্ঞানীরা শুধু বায়ুমণ্ডলে তাকিয়ে নয়, বরং পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকা শত শত উপগ্রহের চোখ দিয়ে প্রতিনিয়ত অনুসরণ করছেন, কীভাবে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া, গলছে বরফ, মরছে বন, আর বুনছে এক অশান্ত ভবিষ্যতের ছক।
উপগ্রহ প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করছে?
উপগ্রহগুলো পৃথিবীর কক্ষপথে থেকে নানান ধরনের সেন্সরের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করছে—মেঘের গঠন, সমুদ্রের উচ্চতা, হিমবাহের পিচ্ছিলতা, বাতাসের গ্যাসীয় গঠন এবং ভূমির তাপমাত্রা। এই সব উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের চিত্র বোঝা সম্ভব হচ্ছে দৈনিক ভিত্তিতে, যা আগেকার যুগে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও বোঝা যেত না।
বিশেষ সেন্সর যেমন MODIS (Moderate Resolution Imaging Spectroradiometer) বা OLI (Operational Land Imager) ব্যবহার করে বর্তমানের উপগ্রহগুলো প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর মাটি ও বায়ুমণ্ডলের তথ্য রেকর্ড করছে। এতে বোঝা যাচ্ছে—বিশ্বের কোন অঞ্চল সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে, কোথায় অরণ্য উধাও হয়ে যাচ্ছে, কোন এলাকায় খরা বা অতিবৃষ্টি হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, এমনকি কৃষিজমিতে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা কতটা কমে যাচ্ছে তাও।
বিপদের বার্তা: ডেটার নেপথ্যে লুকানো সতর্ক সংকেত
মহাকাশ থেকে পাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে-
☞ গ্রিনল্যান্ডের বরফের হারানো গতি আগের তুলনায় চারগুণ বেড়েছে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে দ্রুত গতিতে।
☞ দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বনাঞ্চল বছরে প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টর হারাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে গ্লোবাল অক্সিজেন সাপ্লাই এবং কার্বন শোষণ ক্ষমতায়।
☞ সাহারা অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রতি দশকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বাড়ছে, যা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তায় একটি বড় হুমকি।
☞ উপগ্রহচিত্রে দেখা যাচ্ছে, এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশে বায়ুদূষণের ঘনত্ব এত বেশি যে, তা জনস্বাস্থ্যের জন্য সরাসরি হুমকি।
মানবিক ব্যবস্থাপনায় উপগ্রহের অবদান
উপগ্রহের ডেটা শুধু গবেষণায় নয়-বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও দাবানল পূর্বাভাস দিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে বাস্তবসম্মতভাবে। বিশ্বের বহু কৃষক এখন উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণভিত্তিক কৃষি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে ফসল রোপণ ও সেচের সময় নির্ধারণ করছেন। এছাড়া, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক দেশ এখন নিজেদের জলবায়ু নীতিমালার পরিকল্পনা করছে উপগ্রহ নির্ভর বিশ্লেষণকে ভিত্তি করে।
উপগ্রহ পর্যবেক্ষণের ভবিষ্যৎ কী?
পরবর্তী প্রজন্মের উপগ্রহ যেমন NASA-এর PACE মিশন বা ESA-র Copernicus Climate Initiative, আরও উন্নত স্পেকট্রাল রেজোলিউশন এবং AI-চালিত ডেটা প্রসেসিং ব্যবহার করে পরিবেশগত পরিবর্তনের অগ্রিম চিত্র তুলে ধরবে। এগুলো কেবল তথ্য দেবে না, সরাসরি ভবিষ্যতের বিপদের রূপরেখাও তৈরি করে দেবে, যা এখনো আমাদের মানবিক সিদ্ধান্তের বাইরে।
এই গ্রহের ইতিহাসে এমন সময় খুব কম এসেছে, যখন মানুষ পৃথিবীর চেয়ে মহাকাশ থেকে তার ভবিষ্যৎ বেশি স্পষ্ট করে দেখতে পেয়েছে। উপগ্রহের চোখে ধরা পড়ছে এমন এমন সংকেত, যা উপেক্ষা করলে শুধু একেকটা দেশ নয়, গোটা মানবসভ্যতা চরম ঝুঁকিতে পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাই নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হলো মহাকাশ। আর অস্ত্র? - প্রযুক্তির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আমরা কি সেই সংকেতকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারব? প্রশ্নটা সময়ের কাছে রেখে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।