ডার্মাটাইটিস ও একজিমার অদৃশ্য আগ্রাসন যেভাবে জীবনে আঘাত হানে

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
একটি ছোট চুলকানি দিয়ে শুরু। তারপর লালচে ভাব, ফুসকুড়ি, কখনও ত্বকের খোসা উঠা বা ফেটে যাওয়া। প্রথমে সাধারণ মনে হলেও, এই উপসর্গগুলিই ডেকে আনতে পারে একজিমা ও ডার্মাটাইটিস নামের দুটি জটিল চর্মরোগ। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এই রোগগুলো এখন আর শুধু ত্বকের সীমায় নেই-মানসিক স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রভাব দৃশ্যমান।
ডার্মাটাইটিস: ত্বকের রক্ষাকবচ ভেঙে পড়ার শুরু
ডার্মাটাইটিস মূলত ত্বকের প্রদাহজনিত একটি অবস্থা, যেখানে শরীরের প্রতিরক্ষা প্রাচীর (skin barrier) দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে করে বাইরের জীবাণু, ধুলাবালি, কেমিক্যাল সহজেই ত্বকে প্রবেশ করতে পারে।
সাধারণত তিন ধরণের ডার্মাটাইটিস বেশি দেখা যায়:
- অ্যাটপিক ডার্মাটাইটিস: বংশগত উপাদান ও অ্যালার্জির কারণে হয়। শিশুরা বেশি আক্রান্ত হলেও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও বাড়ছে এর প্রবণতা।
- কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস: কোনও রাসায়নিক বা নির্দিষ্ট বস্তু স্পর্শে চামড়ায় প্রদাহ সৃষ্টি হয়। যেমন–পারফিউম, সাবান, নিকেল, ল্যাটেক্স ইত্যাদি।
-সেবোরিক ডার্মাটাইটিস: সাধারণত মাথার খুলিতে হয়। রূপ নেয় খুশকি বা স্ক্যাল্পের চুলকানিতে।
একজিমা: ত্বকের অ্যালার্জিক ওভাররিঅ্যাকশন
একজিমা আসলে এক ধরনের চর্মপ্রতিক্রিয়া, যেখানে ত্বক অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী (chronic) রোগ, এবং বিশেষভাবে পরিচিত:
- তীব্র চুলকানি ও শুষ্ক ত্বক,
- ত্বকে ফাটল বা র্যাশ,
- রাতে ঘুমহীনতা – কারণ চুলকানি ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়,
- চুলকাতে চুলকাতে সংক্রমণ – ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ বা সেকেন্ডারি ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৫-৩০ কোটিরও বেশি মানুষ একজিমা-সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছে, যার একটি বড় অংশ শিশু-কিশোর। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে রোগটি হালকা হয়ে গেলেও, অনেকেই বছরের পর বছর ধরে ভুগে চলেছেন।
মানসিক চাপও বড় কারণ
ডার্মাটাইটিস ও একজিমা শুধুমাত্র বাইরের কারণেই হয় না। গবেষণা বলছে, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ সরাসরি ত্বকের ওপর প্রভাব ফেলে। কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং প্রদাহের প্রবণতা বাড়ে। তাছাড়া এই রোগের দৃশ্যমান উপসর্গগুলো আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিতে পারে, যার ফলে রোগী মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে—বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে এটি আরও স্পষ্ট।
পরিবেশ ও আধুনিক জীবনযাত্রার প্রভাব
- বাড়িতে অতিরিক্ত ক্লিনার, পারফিউম বা স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার,
- বায়ুদূষণ,
- প্রক্রিয়াজাত খাদ্য (processed food),
- অতিরিক্ত হ্যান্ডওয়াশ ও স্যানিটাইজারের ব্যবহার –
এসব আধুনিক জীবনের অংশ হলেও, ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
চিকিৎসা ও প্রতিকার: প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ উপায়
এই রোগের এখনও পর্যন্ত কোনও স্থায়ী নিরাময় নেই। তবে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে কয়েকটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ কার্যকর হতে পারে:
- ত্বক সবসময় আর্দ্র রাখুন : ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা আবশ্যক।
- সাবান ও কেমিক্যাল মুক্ত জীবন : মাইল্ড, পারফিউম-ফ্রি প্রসাধনী বেছে নেওয়া ভালো।
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন ও স্বাস্থ্যকর খাবার খান : ভিটামিন A, E এবং ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার ত্বকের জন্য উপকারী।
- স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করুন : মেডিটেশন, পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি ত্বকের সুস্থতায় ভূমিকা রাখে।
- পর্যায়ক্রমিক চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন : উপসর্গ তীব্র হলে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ওষুধ বা থেরাপি প্রয়োজন হতে পারে।
ত্বক শরীরের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে স্পর্শকাতর অঙ্গ। ডার্মাটাইটিস ও একজিমা শুধু বাহ্যিক সমস্যা নয়, এটি একটি সামগ্রিক স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ। সচেতনতা, সঠিক জীবনযাত্রা ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নই হতে পারে এই রোগ প্রতিরোধের প্রথম সুরক্ষা-ঢাল।
এই নীরব শত্রুকে চেনা, বোঝা এবং প্রতিরোধ করাই এখন সময়ের দাবি।