অনলাইন শিক্ষার আলো-আঁধারির বাস্তব চিত্র

অনলাইন শিক্ষার আলো-আঁধারির বাস্তব চিত্র
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

যেখানে একসময় শিক্ষা মানেই ছিল মুখোমুখি শ্রেণিকক্ষ, খাতার উপর কলমের আঁচড়, এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে ল্যাপটপ, মোবাইল স্ক্রিন আর অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। 'ভার্চুয়াল ক্লাসরুম' এখন আর শুধু প্রযুক্তির চমক নয়, হয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার বাস্তবতা।

কিন্তু এই প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষায় আমরা কি সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছি? নাকি নিজেদের অজান্তেই প্রবেশ করছি এক অসম প্রতিযোগিতার ভেতর, যেখানে প্রযুক্তি যতটা সহায়, ঠিক ততটাই বিভাজনের কারণ?
 

যেখানে অনলাইন শিক্ষা যুগান্তকারী

১. বিশ্বজোড়া পাঠের সুযোগ: ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের সবচেয়ে বড় শক্তি-সীমানা অতিক্রম। এখন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের একজন শিক্ষার্থীও যুক্ত হতে পারছে ইউরোপ-আমেরিকার নামকরা কোর্সে, অংশ নিতে পারছে MOOC প্ল্যাটফর্মে (যেমন: edX, Coursera)।

২. সময়ের স্বাধীনতা: স্থায়ী সময়সূচির বাইরেও শিক্ষার্থীরা এখন নিজেদের সুবিধামতো সময় বেছে নিয়ে ক্লাস করতে পারছে। বিশেষত যারা কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা করেন, তাদের জন্য এটি এক বিপ্লব।

৩. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সংযোজন: অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো এখন ব্যবহার করছে AI-ভিত্তিক কন্টেন্ট সাজেশন, পারসোনালাইজড ট্র্যাকিং ও ইন্টার‍্যাক্টিভ কুইজ। শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও দুর্বলতাকে বিশ্লেষণ করে তাকে প্রয়োজনীয় রিসোর্স সাজিয়ে দেয়।

৪. রেকর্ডেড ক্লাস সুবিধা: একবার ক্লাস মিস হয়ে গেলে চিন্তার কিছু নেই-রেকর্ডেড লেকচারের মাধ্যমে শিক্ষার্থী বারবার বিষয়টি পুনরায় শিখতে পারে, যা অফলাইন শিক্ষায় সহজ ছিল না।

 

কোথায় অনলাইন শিক্ষার ফাঁকফোকর?

১. ডিজিটাল বিভাজনের বাস্তবতা: বাংলাদেশে এখনো অনেক শিক্ষার্থী ব্রডব্যান্ড, স্মার্ট ডিভাইস কিংবা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শহর ও গ্রাম, ধনী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে 'ডিজিটাল গ্যাপ'।

২. মনোযোগহীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব: অনলাইন ক্লাসে পড়তে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্ত হয়, মনোযোগ হারায়। গুগল মিট বা Zoom-এ 'মিউট' অবস্থায় ক্লাস করলেও জানালার বাইরে মন চলে যেতে পারে সহজেই।

৩. শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি: দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে বসে থাকার ফলে চোখের চাপ, ঘাড়ের ব্যথা, মানসিক চাপ ও ঘুমে ব্যাঘাতের মতো সমস্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এই প্রভাব স্পষ্ট।

৪. মূল্যায়নের স্বচ্ছতা: অনলাইন পরীক্ষায় নকল বা তথ্য ব্যবহার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ছে, যার ফলে প্রকৃত দক্ষতা যাচাই অনেক ক্ষেত্রেই অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে।

 

বিজ্ঞানীরা কী বলছেন?

শিক্ষাবিদ ও প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলছেন-"শুধু প্রযুক্তি নয়, শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।" শিক্ষা যেন ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত না হয়, সেটাও নজরদারির বিষয়।
 

'হাইব্রিড এডুকেশন মডেল'-অর্থাৎ অনলাইন ও অফলাইন শিক্ষার সমন্বয়ে তৈরি হতে পারে ভবিষ্যতের সবচেয়ে কার্যকর ও মানবিক পদ্ধতি।

ভার্চুয়াল ক্লাসরুম নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ধারণা-বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে প্রযুক্তিকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। তবে সব শিক্ষার্থী যেন একইভাবে উপকৃত হয়, সেই নিশ্চয়তা না এলে এই 'অগ্রগতি' আরও গভীর বৈষম্যের জন্ম দিতে পারে।

শুধু প্রযুক্তি নয়-প্রয়োজন সহানুভূতি, অবকাঠামো ও বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা। তাহলেই সত্যিকারের ডিজিটাল শিক্ষা সম্ভব।


সম্পর্কিত নিউজ