শিশুর জ্ঞানের ভুবনে স্ক্রিন নয় বরং বই হোক প্রথম সঙ্গী

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
যেখানে শিশুদের হাতে থাকা উচিত ছিল রঙিন বই, সেখানে এখন দেখা যায় স্ক্রিনভর্তি ভিডিও গেম বা ইউটিউবের অগভীর কনটেন্ট। অথচ প্রাথমিক বিকাশের এই সময়ে বই-ই হতে পারে তাদের কল্পনার জগতের প্রথম জানালা। কিন্তু কীভাবে তৈরি হবে এই বইপাঠের অভ্যাস? গবেষণা বলছে, রঙ, গল্প এবং মানসিক প্রশিক্ষণের সমন্বয়েই গড়ে তোলা যায় শিশুদের বই পড়ার স্বাভাবিক আগ্রহ।
শিশুর জীবনের প্রথম আট বছরকে বলা হয় "brain-building window"। এই সময়ে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ১০ লাখের বেশি নিউরাল সংযোগ গঠিত হয়। বই পড়া এই সংযোগগুলোকে সুসংগঠিত করে—বিশেষত ভাষা, কল্পনা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে।
যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক শিশুবিকাশ গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত বই পড়া শিশুদের মধ্যে শব্দভাণ্ডার ১.৫ গুণ বেশি হয়, তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সহানুভূতিশীল হয়।
বই না কি স্ক্রিন: কোনটি বেশি কার্যকর?
অনেকেই মনে করেন—ই-বুক বা অডিওবুক যথেষ্ট। কিন্তু গবেষণার ফল বিপরীত। প্রিন্টেড বা ছাপানো বই শিশুদের মনোযোগ দীর্ঘ সময় ধরে ধরে রাখে। চিত্র, স্পর্শ, পাতার গন্ধ—সব মিলিয়ে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতা, যা স্ক্রিনে সম্ভব নয়।
শিশুদের আকৃষ্ট করবে যেসব বই
◑ চিত্রনির্ভর: বই যত বেশি ভিজ্যুয়াল হবে, তত বেশি আকৃষ্ট হবে শিশু।
◑ ছোট বাক্যে লেখা, সরল ভাষা: শিশুদের বোঝার উপযোগী হলে আগ্রহ ধরে রাখা সহজ।
◑ কাহিনি ভিত্তিক ও বার্তাবাহী: নৈতিক শিক্ষা বা আবেগনির্ভর ছোট ছোট বার্তা—যেমন 'সততা', 'বন্ধুত্ব', 'পরিশ্রম' ইত্যাদি—শিশুর মনন বিকাশে সহায়ক।
◑ ইন্টারঅ্যাকটিভ উপাদান: ধাঁধা, রঙ করা, প্রশ্নোত্তর অংশযুক্ত বই শিশুদের ভাবনাচিন্তা বাড়ায়।
পড়ার পরিবেশ তৈরি করা: সবচেয়ে উপেক্ষিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
বইপাঠ শুধু বই দিয়েই নয়, তৈরি করতে হয় পরিবেশ দিয়েও। ঘরে একটি ছোট্ট "রিডিং কর্নার", শিশুর চোখের স্তরে বই রাখা, ও প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট গল্প শোনানো—এই অভ্যাসগুলো বইকে শিশুর জীবনের স্বাভাবিক অংশ করে তোলে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুরা যা দেখে, তা শেখে। যদি মা-বাবা নিজেরাও পড়ার অভ্যাস দেখান, শিশুরা তা অনুকরণ করে। পারিবারিক সংস্কৃতিতেই যদি বই থাকে, তাহলে আলাদা করে চাপ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
বিদ্যালয় ও পাঠাগারের দায়িত্ব
বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উচিত শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, গল্প ও ছড়ার বই নিয়মিত পড়ানো। পাশাপাশি শিশুবান্ধব পাঠাগার তৈরি, বুক ক্লাব গঠন এবং "পড়া মানেই আনন্দ" এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। উন্নত দেশগুলোতে প্রি-স্কুল স্তরে বইভিত্তিক গল্পকথার ক্লাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বইপাঠের সুফল শুধু শিক্ষায় নয়, চারিত্রিক গঠনে
বই পড়ার ফলে শিশুর ভাষাগত দক্ষতা যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহানুভূতি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, নিয়মিত বই পড়া শিশুরা ভবিষ্যতে বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়, সমস্যা সমাধানে দক্ষ হয় এবং সহানুভূতির মান থাকে উচ্চতর।
ভবিষ্যৎ গড়ার শুরু হোক বইয়ের পাতা থেকে
শিশুর হাতে যখন একটি ভালো বই তুলে দেওয়া হয়, তখন কেবল একটি গল্প নয়—তাকে উপহার দেওয়া হয় একটি নতুন জগৎ, ভাবনার খোরাক এবং ভাষার হাতিয়ার। প্রযুক্তির যুগে বই পড়ার অভ্যাস ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং হলেও অসম্ভব নয়। সঠিক কৌশল, সহানুভূতি ও ধৈর্য নিয়ে এগিয়ে গেলে বই হতে পারে শিশুর মানসিক বিকাশের সেরা মাধ্যম।
সূত্র:
- শিশুবিকাশ ও শিক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনসমূহ, এবং
- ইউনিসেফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন দিকনির্দেশনা বিশ্লেষণ।