চাকরির দৌড়ে পিছিয়ে নেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিস্তৃত কাঠামো, যার অধীনে দেশের প্রায় ২,২৫০টি কলেজে প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়ন করেন। এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশই দেশের চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো-তারা কি আদৌ প্রতিযোগিতামূলক এই বাজারে টিকে থাকতে পারছেন?
দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সমাজে একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত—তারা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তথ্য ও প্রযুক্তির প্রসার, স্কিল বেইজড প্রশিক্ষণের সহজলভ্যতা, ও নিয়োগপ্রক্রিয়ার পরিবর্তনের ফলে এই বাস্তবতা দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
চাকরির বাজারে প্রবেশের বাস্তব চিত্র
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (BIDS)-এর সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত নতুন কর্মীদের মধ্যে প্রায় ৩২% জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবেশ ঘটেছে আইটি, ব্যাংকিং, শিক্ষা ও পাবলিক সার্ভিস সেক্টরে।
বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরের মতো পরীক্ষাভিত্তিক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও সফলতার হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৩ সালের একটি সরকারি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় নির্বাচিতদের মধ্যে ২৮% ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট।
ফ্রিল্যান্সিং ও আইটি খাতে উত্থান
তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের একটি বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, দেশের শীর্ষ ২০ হাজার সফল ফ্রিল্যান্সারের প্রায় ৪০%-এর শিক্ষাগত ভিত্তি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রযুক্তিনির্ভর প্ল্যাটফর্ম যেমন Coursera, Udemy, YouTube এবং LinkedIn Learning—এসব ব্যবহার করে তারা নিজেরাই স্কিল ডেভেলপ করছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন স্বল্প খরচে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পান, অন্যদিকে স্থানীয় বাস্তবতায় মানিয়ে চলার অভ্যাস তাদের সহনশীল ও উদ্ভাবনী করে তোলে।
দক্ষতার ঘাটতি বনাম প্রবেশযোগ্যতা
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে—সেশন জট, গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা বা প্র্যাকটিক্যাল এক্সপোজারের অভাব, ও ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ না থাকা। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হন না, অথবা গাইডলাইনের অভাবে সঠিক প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হন।
তবে সম্প্রতি NU কর্তৃপক্ষ ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে, যা শিক্ষার্থীদের নিজস্ব গতিতে শেখার সুযোগ দিচ্ছে। পাশাপাশি, Soft Skills যেমন—কমিউনিকেশন, টাইম ম্যানেজমেন্ট, লিডারশিপ—এই বিষয়গুলোকেও পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার আলোচনা চলছে।
নিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
বর্তমানে নিয়োগকারীরা শুধু প্রতিষ্ঠান দেখে প্রার্থী নির্বাচন করছেন না; তারা যাচাই করছেন প্রার্থীর স্কিলসেট, প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা। একাধিক হিউম্যান রিসোর্স কনসালট্যান্টরা বলছেন—"জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী স্বপ্রণোদিত হয়ে স্কিল ডেভেলপ করেন, যার ফলে তারা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে পারছেন।"
বাজার-চাহিদা ও ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
বর্তমানে যে দক্ষতাগুলো চাকরির বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন তা হলো:
⇨ ডেটা অ্যানালাইসিস ও বিজনেস ইন্টেলিজেন্স
⇨ ডিজিটাল মার্কেটিং ও কনটেন্ট ক্রিয়েশন
⇨ ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট
⇨ সেলস ও ক্লায়েন্ট রিলেশন ম্যানেজমেন্ট
⇨ ভাষাগত দক্ষতা (ইংরেজি এবং অন্যান্য বিদেশি ভাষা)
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি এই স্কিলগুলো অর্জনে মনোযোগ দেন, তবে তাদের জন্য চাকরির বাজারে অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হয়তো একাডেমিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেন, তবে তারা পিছিয়ে নেই। বাস্তবমুখী চিন্তা, অনলাইন রিসোর্সের সদ্ব্যবহার, আত্মপ্রত্যয় এবং কঠোর পরিশ্রম—এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের চাকরির বাজারে টিকিয়ে রাখছে এবং সফল করছে।
এই বাস্তবতা এখন কেবল ব্যতিক্রম নয়, বরং একটি নতুন ধারা। উপযুক্ত দিকনির্দেশনা, সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় এবং স্কিল বেইজড শিক্ষানীতির মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরাই হয়ে উঠতে পারেন দেশের অন্যতম বড় মানবসম্পদ—তা আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই।