বনজীবন ও গাছের ইকোলজিক্যাল ইম্পর্ট্যান্স

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
গাছ না থাকলে জীবন থেমে যাবে—এই সত্যটা শুনতে সহজ, কিন্তু বুঝতে সময় লাগে। পৃথিবীর প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি ফোঁটা পানি, এমনকি আকাশে জমে থাকা মেঘ—all linked back to forests. গাছ ও বনজীবনের এই জৈব-চক্রে লুকিয়ে আছে মানুষের টিকে থাকার মূল রহস্য।
বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তন, খরা, বন্যা, দুর্যোগ ও দুর্বল জনস্বাস্থ্যের জন্য দায়ী একটি সাধারণ কারণ—বন উজাড়। অথচ বনভূমির গুরুত্ব কেবল মাত্র 'সবুজায়ন' বা পরিবেশ রক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি পৃথিবীর প্রাকৃতিক 'লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম'। গাছ ছাড়া আমাদের খাদ্য, পানি, বায়ু—সব কিছুই হুমকির মুখে পড়ে।
➤ বৈজ্ঞানিকভাবে গাছের অবদান
১. অক্সিজেন উৎপাদন ও কার্বন শোষণ: প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ২২ কেজি অক্সিজেন উৎপাদন করে। এটি একটি পরিবারের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের একটা বড় অংশ পূরণ করতে সক্ষম। অন্যদিকে, একই গাছ বছরে ১০০ কেজির বেশি CO₂ শোষণ করে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর একটি অদৃশ্য কিন্তু বিশাল ভূমিকা রাখে।
২. ফটোসিনথেসিস ও শক্তি চক্র: গাছ সূর্যের আলো ব্যবহার করে বাতাসের CO₂ আর মাটির পানি থেকে খাদ্য তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন গ্লুকোজ দিয়ে গাছ নিজের বৃদ্ধি ঘটায় এবং অন্য প্রাণীদেরও পরোক্ষভাবে খাদ্য জোগায়। পুরো প্রাণিকুল এই শক্তি চক্রে নির্ভরশীল।
৩. ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ ও বৃষ্টির সৃষ্টি: গাছপালা ট্রান্সপিরেশন প্রক্রিয়ায় মাটির পানি বাষ্পে রূপান্তর করে, যা বাতাসে মিশে গিয়ে মেঘ সৃষ্টি করে। এতে করে নির্দিষ্ট অঞ্চলে নিয়মিত বৃষ্টিপাত নিশ্চিত হয়। আমাজনের মতো রেইনফরেস্ট নিজেই তার আবহাওয়া তৈরি করে—এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশেও তার প্রভাব পড়ে।
➤ বন মানেই প্রাণের ঘর
বনভূমি কোনো ফাঁকা জায়গা নয়, বরং একেকটি জীবন্ত ল্যাবরেটরি। এক একর প্রাকৃতিক বনে প্রায় ৪০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৫০টির বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণী বাস করতে পারে। বাংলাদেশে সুন্দরবন হচ্ছে এর বড় উদাহরণ—এখানকার গাছ শুধু বাঘের বা হরিণের জন্য না, এটি লাখ লাখ মানুষের জীবনধারণের অবলম্বন।
বনের ভূমিকা এখানেই শেষ না—এটি ভূমিক্ষয় রোধ করে, নদীর গতিপথ সুরক্ষিত রাখে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগে ঢাল হিসেবে কাজ করে। উপকূলবর্তী বনাঞ্চল যেমন ম্যানগ্রোভ গাছ, প্রাকৃতিকভাবে সাইক্লোনের ধাক্কা অনেকটাই ঠেকাতে সক্ষম।
➤ মানসিক স্বাস্থ্যেও গাছের প্রভাব
নিউরোসায়েন্সের গবেষণায় দেখা গেছে, সবুজ পরিবেশে মানুষ বেশি শান্ত থাকে, উদ্বেগ কমে যায় এবং মনোযোগ শক্তি বাড়ে। শহরের একঘেয়ে কংক্রিটের জঙ্গল থেকে বের হয়ে যদি কেউ সপ্তাহে ২-৩ ঘণ্টা প্রকৃতির মাঝে কাটাতে পারে, তাহলে তাদের মধ্যে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। Forest bathing (Shinrin-yoku) নামে জাপানে গাছের সাথে সময় কাটানোর একটি প্রথাও রয়েছে—যা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বাস্থ্যচর্চা।
➤ পরিসংখ্যান বলছে ভয়ংকর গল্প
⇨ FAO-এর রিপোর্ট মতে, প্রতি মিনিটে পৃথিবী হারাচ্ছে এক ফুটবল মাঠের সমান বন।
⇨ গত ৫০ বছরে পৃথিবীর অর্ধেক প্রাকৃতিক বন ইতোমধ্যেই ধ্বংস হয়েছে।
⇨ শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি বছর ৩-৪% হারে বনভূমি কমছে।
⇨ বাংলাদেশে ১৯৯০ থেকে ২০২0 পর্যন্ত গাছপালাভিত্তিক বনভূমি কমেছে প্রায় ১১.২%।২০২৩ সালে, বাংলাদেশে প্রায় ১৭,৮০০ হেক্টর বনভূমি হারিয়েছে। ২০২৪ সালে, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, বনভূমি হ্রাসের হার অব্যাহত রয়েছে, তবে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ এখনও প্রকাশিত হয়নি।
এই তথ্যগুলো বাস্তবতা বোঝাতে যথেষ্ট—আমরা ঠিক কোন পথে এগোচ্ছি?
➤উন্নয়ন বনাম ধ্বংস নয়—চাই ভারসাম্য
হ্যাঁ, উন্নয়নের জন্য জমির দরকার, নগরায়নের জন্য অবকাঠামো চাই। কিন্তু সেটা যদি বনের বিনিময়ে হয়, তাহলে উন্নয়নের সেই পথ হবে অস্থায়ী, আত্মঘাতী। স্মার্ট প্ল্যানিং, রি-ফরেস্টেশন, আরবান গ্রিন জোন, এবং প্রাকৃতিক সংরক্ষণ—এই পথেই হতে পারে স্থায়ী সমাধান।
➤কি করতে পারি আমরা?
⇨ নিজে গাছ লাগান, অন্যকে উৎসাহ দিন।
⇨ ব্যক্তিগত জীবনে কাগজ, কাঠ, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমান।
⇨ স্থানীয় বন সংরক্ষণ প্রকল্পে যুক্ত হোন।
⇨ বনের জন্য আওয়াজ তুলুন—রাজনীতি না, সচেতনতা হোক হাতিয়ার।
গাছ শুধু নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত কাঠামো নয়—এটি আমাদের পৃথিবীর ইঞ্জিন। বন ধ্বংস মানেই জীবনধারণের ভিত্তি ধ্বংস। নিজের ভবিষ্যৎকে ভালোবাসলে, গাছকেও ভালোবাসতে হবে।